ভোলাগঞ্জের পর এবার সুনামগঞ্জে পাথর হরিলোটের পায়তারা
বিশেষ প্রতিবেদনে : অমিত তালুকদার
সারাদেশে আলোচিত ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের অবৈধ সরবরাহ নিয়ে প্রশাসন তৎপর থাকলেও নতুন করে সুনামগঞ্জের সুরমা ব্রিজ (আব্দুর জহুর সেতু) সংলগ্ন কুতুবপুর এলাকায় পাথর লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। জান্নাত এন্টারপ্রাইজ এন্ড স্টোন ক্রাশার মিলে পাওয়া নিলামের পাথরের সঙ্গে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের মিশ্রণের অভিযোগে বিষয়টি নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
মালিকের দাবি বনাম কাগজের অসঙ্গতি
অনুসন্ধানী দল মালিক মোঃ শহীদ আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন—
“এই পাথর অবৈধ নয়, আমি নিলামের মাধ্যমে এক লাখ ঘনফুট পাথর কিনেছি। আমার কাছে কাগজপত্রও আছে।”
কিন্তু তাঁর প্রদত্ত কাগজে বড় ধরনের অসঙ্গতি চোখে পড়ে।
কাগজে উল্লেখ আছে মোট ২,৯৯,৪৩২ ঘনফুট পাথরের কথা, অথচ শহীদ আলমের দাবি মাত্র ১ লাখ ঘনফুট।
কাগজে অংশগ্রহণকারীর নাম মোছাঃ সেলিনা আক্তার, আদন ড্রেজিং লিমিটেড, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।
সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন সৈয়দ মনিরুজ্জামান ও মোঃ কবির হোসেন।
কোথাও শহীদ আলম বা জান্নাত এন্টারপ্রাইজের নাম নেই।
ফলে প্রশ্ন উঠছে—তিনি কীভাবে বিপুল পরিমাণ পাথরের মালিকানা দাবি করছেন?
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান—
“নিলামের নাম করে রাতের আধারে অন্য জায়গা থেকে পাথর আনা হয়।”
“কেউ জানে না এই পাথরগুলো কোথা থেকে আসে।”
“সাদা পাথরের সঙ্গে অন্য কোয়ারির পাথর মিশ্রণ নতুন নয়।”
তাদের দাবি—বর্তমানে সুনামগঞ্জের সব কোয়ারি বন্ধ, তাই বৈধ পথে এত পাথর আসার কোনো সুযোগ নেই।
প্রশাসনিক অসঙ্গতি
কাগজে উল্লেখ আছে—পাথর হস্তান্তরের তারিখ ২৫ জুন ২০২৫। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সব পাথর স্থানান্তর হয়নি। শহীদ আলমের দাবি তিনি অর্ধেক পাথর পেয়েছেন, বাকি আনতে পারেননি। কিন্তু কেন আনতে পারেননি—সে বিষয়ে সঠিক জবাব দিতে পারেননি তিনি।
অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য
“দৈনিক ঘোষণা”-এর অনুসন্ধান দল ঘটনাস্থল ধোপাজান নদীর পশ্চিমপাড়ে গিয়ে ভিন্ন চিত্র দেখতে পায়। সেখানে প্রায় ১০ লক্ষ ঘনফুটেরও বেশি পাথর মজুদ রয়েছে। গ্রামজুড়ে বাড়ির সামনে অবৈধভাবে স্তূপ করে রাখা পাথরের দৃশ্য চোখে পড়ে।
স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান—
নিলামের কাগজে দেখানো সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি পাথর তারা নিয়ে গেছেন।
২,৯৯,৪৩২ ঘনফুটের নিলাম কাগজকে অজুহাত করে অবৈধ পাথর লুট চলছে।
দিনে-দুপুরে কিংবা রাতে সুযোগ বুঝে ট্রলি গাড়িতে এসব পাথর পাচার করা হচ্ছে।
সাংবাদিককে হুমকি
শহীদ আলমের ক্রাশার মিলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের উদ্দেশে বলেন—
“সুনামগঞ্জে আড়াইশো সাংবাদিক আছেন, কিন্তু কেউ এখানে আসে না। আপনি এসেছেন—এটাই বড় বিষয়।”
এই বক্তব্যকে অনুসন্ধানী দল হুমকিমূলক আচরণ হিসেবে দেখছে। এতে স্পষ্ট, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কার্যক্রম তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
প্রশাসনের বক্তব্য
এ বিষয়ে বিশ্বম্ভপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেরিন দেবনাথ বলেন—
“নিলামের পাথর নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। আমরা এ বিষয়ে ডিসি স্যারের সঙ্গে আলোচনা করবো। প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।”
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, যে সব অবৈধ পাথর নিলামের আওতায় নেই, সেগুলো জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। জেলা প্রশাসন বলছে, অবৈধভাবে মজুদকৃত এসব পাথর জব্দ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে।
মূল প্রশ্নগুলো
১. শহীদ আলমের নাম কাগজে নেই, তবু তিনি কীভাবে বৈধ মালিক দাবি করছেন?
২. এক লাখ বনাম প্রায় তিন লাখ ঘনফুট—সংখ্যাগত বৈপরীত্য কেন?
৩. ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর মিশ্রিত হলে প্রশাসন কীভাবে তা শনাক্ত করছে?
৪. নিষিদ্ধ অবস্থায় এত বিপুল পরিমাণ পাথর কোথা থেকে এলো?
৫. জব্দকৃত অবৈধ পাথরগুলো কত দ্রুত সরকারি কোষাগারে জমা পড়বে?
৬. সাংবাদিককে হুমকির ঘটনায় প্রশাসন কি আলাদা পদক্ষেপ নেবে?
জান্নাত এন্টারপ্রাইজ এন্ড স্টোন ক্রাশারের নিলামের পাথর নিয়ে অসঙ্গতি, মালিকের দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য, সাংবাদিককে হুমকি, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অবৈধ পাথর মজুদ এবং প্রশাসনিক শৈথিল্যের কারণে নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে সুনামগঞ্জের পাথর খাত। এখন নজর জেলা প্রশাসনের দিকে—তারা কীভাবে এই পাথর জব্দ, সাংবাদিক নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে পরিস্থিতি সামাল দেয়, সেটিই দেখার বিষয়।