নব আনন্দে বর্ষবরণ, বেদনার নীরবতাঃ রমনা বটমূলে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের শুভ সূচনা
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন।
নতুন সূর্যের আলো আর প্রকৃতির নবীনতার স্পর্শে আজ সোমবার (১৪ এপ্রিল) সারাদেশে উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২। চিরায়ত ঐতিহ্য আর উদ্দীপনার আবহে মুখরিত চারপাশ। তবে, অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ সুর ছিল—ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
রাজধানী ঢাকার রমনা পার্কের বটমূল বরাবরের মতোই ছিল বর্ষবরণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই আবালবৃদ্ধবনিতা দলে দলে সমবেত হন ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’—এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ছায়ানটের শিল্পীরা সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তির মনোমুগ্ধকর পরিবেশনার মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেন। বাঁশির সুর, ঢোলের বাদ্য আর সমবেত কণ্ঠের গানে মুখরিত হয়ে ওঠে রমনার সবুজ প্রাঙ্গণ।
অনুষ্ঠানে প্রকৃতির বন্দনা, নতুন জীবনের জয়গান এবং বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে, আনন্দ-উল্লাসের মাঝেও একটি গভীর বেদনার ছায়া নেমে আসে যখন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ও গণহত্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বিশেষ করে শিশু হত্যার তীব্র নিন্দা জানান তিনি এবং ফিলিস্তিনবাসী তাদের ভূমি রক্ষায় যে সংগ্রাম করছেন, তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। এরপর ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে শিল্পী ও দর্শনার্থীরা দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এই নীরবতা যেন বিশ্ব মানবতার প্রতি এক নীরব বার্তা পৌঁছে দেয়—সহিংসতা আর রক্তপাত নয়, শান্তি ও সহানুভূতির জয় হোক।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে ছায়ানটের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। তবে, রমনা বটমূলে আগত মানুষের মনে নতুন বছরের আগমনীর আনন্দ এবং গাজার নিহতদের জন্য গভীর সমবেদনার এক মিশ্র অনুভূতি সঞ্চারিত হয়।
শুধু রমনা বটমূল নয়, সারা দেশেই পহেলা বৈশাখের নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শোভাযাত্রা, লোকনৃত্য, গান, কবিতা আবৃত্তি, গ্রামীণ মেলা এবং ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে। তবে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় অনেক স্থানেই সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। জনসমাগম এড়িয়ে ভার্চুয়ালিও অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে।
ছায়ানট ১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। দীর্ঘ এই পথচলায় এই অনুষ্ঠানটি বাঙালির সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এবছর ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেওয়ার জন্য গত তিন মাস ধরে ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে চলে গানের মহড়া। রমনা বটমূলে মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয় ৮ এপ্রিল।
বর্ষবরণের এই আনন্দঘন দিনে নতুন করে জেগে উঠুক বাঙালির চেতনা। দূর হোক সকল অমানবিকতা আর সংঘাত। নতুন বছর বয়ে আনুক সকলের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ—এই প্রত্যাশাই আজ ধ্বনিত হচ্ছে রমনার বটমূল থেকে শুরু করে সারা বাংলার প্রতিটি প্রান্তে। একইসঙ্গে, গাজায় নিহতদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, বিশ্ব মানবতার মুক্তি এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এখনও চলমান রয়েছে বিশ্ব দরবারে।