আল্লাহর প্রদত্ত দুই ধরনের জ্ঞানঃ ইলমে হুসুলি ও ইলমে হুজুরি!
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন এর লেখা ও সম্পাদনায় রচিত।
আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ ও জিন জাতিকে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবন পরিচালনার জন্য দুই ধরনের বিশেষ জ্ঞান দান করেছেন। এই দুটি জ্ঞান হলো ইলমে হুসুলি (জাগতিক জ্ঞান) এবং ইলমে হুজুরি (আধ্যাত্মিক জ্ঞান)। এই দুটি জ্ঞান একে অপরের পরিপূরক এবং একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এই দুই জ্ঞানের গভীর তাৎপর্য ও গুরুত্ব নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো
** ইলমে হুসুলি [জাগতিক জ্ঞান]:- ইলমে হুসুলি হলো সেই জ্ঞান যা আমরা প্রাকৃতিকভাবে, আমাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে অর্জন করি। শৈশব থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত আমরা পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা) এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই জ্ঞান লাভ করি। এই জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, চিকিৎসাবিদ্যা এবং অন্যান্য জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
* কোরআনের আলোকেঃ পবিত্র কোরআন মানুষকে জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে। আল্লাহ বলেন,
☞ “বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?” (সূরা যুমার: ৯).
এই আয়াতে জ্ঞান অর্জনের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ইলমে হুসুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে এবং পৃথিবীকে আরও সুন্দর ও উন্নত করতে সাহায্য করে। এই জ্ঞান ছাড়া আমরা আমাদের জীবিকা নির্বাহ, সমাজের সেবা বা মানবিক কল্যাণ সাধন করতে পারতাম না। এটি আল্লাহর দেওয়া এক নেয়ামত, যা ব্যবহার করে আমরা তাঁর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা ও চিন্তা করতে পারি।
* হাদিসের আলোকে: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছে,
☞ “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ।” (সুনানে ইবনে মাজাহ).
এই হাদিসটি জ্ঞানের ব্যাপকতাকে নির্দেশ করে। এখানে শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই নয়, বরং জাগতিক জ্ঞানও অন্তর্ভুক্ত। এই জ্ঞান আমাদের ইহকালীন জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে অপরিহার্য।
** ইলমে হুজুরি [ আল্লাহর প্রদত্ত জ্ঞান ]:- ইলমে হুজুরি হলো সেই গভীর ও সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যা কোনো জাগতিক মাধ্যম দ্বারা অর্জন করা যায় না। এই জ্ঞান আল্লাহ তা’আলা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে সেইসব বান্দাদের দান করেন, যারা হালাল অর্থ উপার্জন করে, হালাল খাদ্য গ্রহন করে এবং সমস্ত প্রকার মিথ্যা, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, অন্যের ক্ষতি সহ এই পৃথিবীর বুকে যাবতীয় ফেৎতনা ফ্যাসাদ পরিহার করিয়া নিজেদের নফ্সকে পরিশুদ্ধ করে কঠোর সাধনার মাধ্যমে নিজের ভিতরের পৃথিবী কামিয়াবী ভাবের পশুত্ব ও আমিত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন বা ত্যাগ করে চলে এবং ” তাঁর ( মহান আল্লাহ তায়ালার ) নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে।”- এই জ্ঞানকে ইলমে লাদুনি বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানও বলা হয়।
* কোরআনের আলোকেঃ- পবিত্র কোরআনে হযরত মূসা (আ.) এবং হযরত খিজির (আ.)-এর ঘটনা ইলমে হুজুরির এক অনন্য উদাহরণ। আল্লাহ তা’আলা হযরত খিজির (আ.)-কে তাঁর পক্ষ থেকে বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন। কোরআনে বলা হয়েছে, “অতঃপর তারা সাক্ষাৎ পেল আমার বান্দাদের মধ্যে একজনের, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম এবং আমার পক্ষ থেকে বিশেষ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলাম।” (সূরা কাহফ: ৬৫).
এই জ্ঞান এতটাই গভীর ছিল যে, জাগতিক জ্ঞানের অধিকারী হযরত মূসা (আ.)-ও তাহা সহজে বুঝতে পারেননি। এই জ্ঞানের মাধ্যমেই আল্লাহর প্রকৃত বন্ধুরা অদৃশ্য জগৎতের অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারেন। আল্লাহ আরও বলেন- “আমি যাকে যখন যে অবস্থায় ইচ্ছা করি, তাকে আমার জ্ঞান দান করি।” (সূরা বাকারা: ২৬৯).
এই আয়াতটি ইঙ্গিত দেয় যে ইলমে হুজুরি আল্লাহর ইচ্ছাধীন একটি বিশেষ দানকৃত জ্ঞান।
* হাদিসের আলোকেঃ- রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, “যখন কোনো বান্দা একাগ্রতা চিত্তে অতিরিক্ত নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করে, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে; তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে; তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে; এবং তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে।”
এই হাদিসটি আধ্যাত্মিক উন্নতির সর্বোচ্চ স্তরকে বোঝায়, যেখানে বান্দার সত্তা আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ইলমে হুজুরির অধিকারী ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে অদৃশ্য অনেক বিষয় অবলোকন করতে পারেন। তাদের ‘অন্তর্দৃষ্টি’ বা ‘তৃতীয় চোখ’ খুলে যায়, যা দিয়ে তারা সৃষ্টির রহস্য এবং নিজেদের অস্তিত্বের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারেন। এটি কোনো জাদু বা অলৌকিক ক্ষমতা নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত একটি বিশেষ অনুগ্রহ বা দান।
** উভয় জ্ঞানের অপরিহার্যতার সম্পর্কঃ- ইলমে হুসুলি ও ইলমে হুজুরি একে অপরের পরিপূরক। জাগতিক জ্ঞান আমাদের পার্থিব জীবনকে পরিচালনা করে এবং আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণার সুযোগ দেয়। অন্যদিকে, আধ্যাত্মিক জ্ঞান আমাদের আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে। যারা শুধুমাত্র জাগতিক জ্ঞান দিয়ে সবকিছুর বিচার করতে চায়, তারা ইলমে হুজুরির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে না এবং অনেক সময় এই জ্ঞানকে অবজ্ঞা করে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানীরা জানেন যে, এই দুটি জ্ঞানই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এক মহান নেয়ামত।
আমাদের জীবন তখন-ই পূর্ণতা লাভ করবে যখন আমরা উভয় জ্ঞানের সম্মলিত সমন্বয় পার্থিব বাস্তব জীবনে ঘটাতে পারব। ইলমে হুসুলি আমাদের পার্থিব জীবনকে সুন্দর ও সফল করে তোলে, আর ইলমে হুজুরি আমাদের ইহকাল ও পরকালীন জীবনের পথকে আলোকিত করে। এই দুই জ্ঞানের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করে, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা এবং প্রকৃত ইসলামের আদর্শে আদর্শিত হইয়া সমগ্র সৃষ্টি জগৎতের সকল সৃষ্টি সহ সৃষ্টি কুলের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবজাতির মঙ্গল ও কল্যাণ সাধন করে ধর্মীয় তাত্ত্বিকতায় একজন মমিন-মুত্তাকীত্ব অর্জনপূর্বক, মুক্তি প্রাপ্ত কামেল সাধক বা প্রকৃত মুসলমান হওয়া সম্ভব………….. ইনশাল্লাহ্- আমিন।