লতিফা সমূহের পরিচয় ও তাৎপর্যঃ কোরআন ও হাদিসের আলোকে তাসাউফের নিগূঢ় তত্ত্ব!!
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন এর লেখা ও সম্পাদনায় রচিত।
এই বিষয়টির উপর একটি বিস্তৃত বিবরণী ও গভীর তত্ত্বগত দিক আলোচনা করা সাধারণ জাগতিক/হুসুলী জ্ঞানে বেশ জটিল ও কঠিনতম অধ্যায়, কারণ এটি ইসলামের আধ্যাত্মিক পথের (হুজুরি/তাসাউফ) জ্ঞানের একটি বিশেষ অংশ, যা কোরআন ও হাদিসের বাহ্যিক ব্যাখ্যার চেয়েও অধিকতর গভীরতম দিক। কালব, রুহু, ছের, খফি, আকফা, আব, আতশ, খাক, বাদ, নাফস- এই শব্দগুলো তাসাউফ বা সুফিবাদে ব্যবহৃত কিছু পরিভাষা, যা মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তা ও তার বিভিন্ন স্তরের পরিচয় দেয়।
** তাসাউফের প্রেক্ষাপটে্ শারীরিক লতিফা সমূহঃ-
তাসাউফ অনুযায়ী, মানুষের সত্তা শুধুমাত্র শারীরিক নয়, বরং এর একটি আধ্যাত্মিক দিকও আছে। এই আধ্যাত্মিক সত্তার বিভিন্ন স্তরকে লতিফা বলা হয়। লতিফা শব্দের অর্থ সূক্ষ্ম, অদৃশ্য বা গোপনীয়। সুফি সাধকরা ধ্যান, যিকির ও মুরাকাবা (আধ্যাত্মিক অনুশীলন) -এর মাধ্যমে এই লতিফাগুলোকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন, যাতে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারেন। এই লতিফাগুলো মানুষের আত্মার বিভিন্ন শক্তি ও গুণাবলীর প্রতিনিধিত্ব করে।
** লতিফাসমূহের পরিচয় ও কার্যকারিতাঃ- লতিফাগুলোকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়ঃ>
* লতিফায়ে হেসিয়া (শারীরিক লতিফা): যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত।
* লতিফায়ে কলবিয়া (আত্মিক লতিফা): যা হৃদয় ও আত্মার সাথে সম্পর্কিত।
এখানে আমি যে শব্দগুলো উল্লেখ করেছি, সেগুলো এই দুই ভাগের মিশ্রণ। নিচে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও কার্যকারিতা তুলে ধরা হলোঃ
** ১. কালব (হৃদয়):>
* পরিচয়ঃ এটি মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তার কেন্দ্র। যদিও এটি শারীরিক হৃদপিণ্ড নয়, তবে এর অবস্থান বুকের বাম পাশে বলে মনে করা হয়।
* কার্যকারিতা ও উপকারিতাঃ এটি ঈমান, জ্ঞান, ভালোবাসা, এবং আল্লাহর ভয় ধারণ করে। হাদিসে এসেছে, "শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড আছে, যখন সেটি সুস্থ থাকে, তখন পুরো শরীর সুস্থ থাকে; আর যখন সেটি অসুস্থ হয়, তখন পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সেটি হলো কালব (হৃদয়)।" কোরআনে আল্লাহ বলেন, "তারা কি কোরআন নিয়ে গবেষণা করে না, নাকি তাদের অন্তরে তালা দেওয়া আছে?" এই আয়াতগুলো কালবের গুরুত্ব তুলে ধরে। কালবকে পরিশুদ্ধ করা তাসাউফের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।
** ২. রুহু (আত্মা):>
* পরিচয়ঃ এটি মানুষের জীবনের মূল শক্তি। কোরআনে বলা হয়েছে, "রুহ আমার রবের নির্দেশ থেকে এসেছে।" এটি একটি সূক্ষ্ম সত্তা যা আল্লাহর আদেশ দ্বারা সৃষ্ট।
* কার্যকারিতা ও উপকারিতাঃ এটি মানুষকে জীবিত রাখে এবং তার আধ্যাত্মিক দিককে সক্রিয় করে। সুফি সাধকদের মতে, রুহ যখন জাগ্রত হয়, তখন মানুষ আল্লাহর আদেশ পালনে অধিক আগ্রহী হয় এবং তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ অনুভব করে।
** ৩. ছের (গোপন):>
* পরিচয়ঃ এটি কালবের চেয়েও সূক্ষ্ম একটি লতিফা। এটি মানুষের গোপন সত্তা, যা শুধুমাত্র আল্লাহ জানেন।
* কার্যকারিতা ও উপকারিতাঃ ছের হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে আল্লাহর গোপন জ্ঞান ও রহস্যের প্রতিফলন ঘটে। এটি জাগ্রত হলে মানুষ আল্লাহর গোপন রহস্য সম্পর্কে কিছু ধারণা লাভ করতে পারে।
** ৪. খফি (অদৃশ্য):>
* পরিচয়ঃ এটি ছেরের চেয়েও বেশি গোপন ও অদৃশ্য একটি লতিফা। এটি মানব অস্তিত্বের চূড়ান্ত গভীরতম স্তর।
* কার্যকারিতা ও উপকারিতাঃ এটি যখন সক্রিয় হয়, তখন মানুষের মধ্যে আল্লাহকে জানার গভীর আগ্রহ ও প্রেম সৃষ্টি হয়।
** ৫. আকফা (সর্বাধিক গোপন):>
* পরিচয়ঃ এটি লতিফাসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে গোপনীয় স্তর। এর অবস্থান রুহ ও ছেরের মাঝে বলে ধারণা করা হয়।
* কার্যকারিতা ও উপকারিতাঃ এটি আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর জ্ঞান ধারণ করে। এই লতিফা জাগ্রত হলে মানুষ 'ফানা' (আল্লাহর সত্তায় বিলীন) হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করে।
চারটি মৌলিক উপাদানের লতিফা (তাশাউফের প্রেক্ষাপটে)
তাসাউফে মানুষের শারীরিক সত্তা চারটি মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত বলে বিশ্বাস করা হয়, যা গ্রিক দার্শনিকদের ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণঃ-
** ৬. আব (জল):> এটি মানুষের মধ্যে আবেগ, অনুভূতি ও কোমলতার প্রতীক। এটি চোখের পানি, ঘাম ও অন্যান্য তরল পদার্থের সাথে সম্পর্কিত।
** ৭. আতশ (অগ্নি):> এটি রাগ, ক্রোধ, অহংকার ও উত্তেজনার প্রতীক। এটি মানুষের মধ্যেকার শয়তানি প্রবৃত্তি।
** ৮. খাক (মাটি):> এটি মানুষের মধ্যে স্থায়িত্ব, ধীরতা ও সহনশীলতার প্রতীক। এটি মানুষের শরীর ও তার বস্তুগত অস্তিত্ব।
** ৯. বাদ (বাতাস):> এটি মানুষের মধ্যে গতিশীলতা, পরিবর্তন ও অস্থিরতার প্রতীক। এটি চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সম্পর্কিত।
এই চারটি উপাদানকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখা তাসাউফের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
** ১০. নাফস (প্রবৃত্তি):>
* পরিচয়ঃ এটি মানুষের নিম্ন প্রবৃত্তি বা কামনা-বাসনার কেন্দ্র। এটি মানুষের মধ্যে মন্দ কাজের প্ররোচনা দেয়।
* কার্যকারিতা ও উপকারিতাঃ কোরআনে নাফসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে: নাফসে আম্মারা (মন্দ কাজের আদেশকারী), নাফসে লাওয়ামাহ (আত্ম-ধিক্কারকারী) এবং নাফসে মুতমাইন্নাহ (প্রশান্ত)। তাসাউফের লক্ষ্য হলো নাফসে আম্মারাকে পরিশুদ্ধ করে নাফসে মুতমাইন্নাহ্ স্তরে উন্নীত করা।
**কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিগূঢ় তত্ত্বঃ-
এই লতিফা সমূহের ধারণা কোরআন ও হাদিসের সরাসরি কোনো আয়াতে বা বর্ণনায় পাওয়া যায় না। বরং এটি সুফি সাধকদের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ও গভীর চিন্তাভাবনার ফসল, যা তারা কোরআন ও হাদিসের ইঙ্গিতপূর্ণ আয়াত ও বর্ণনা থেকে লাভ করেছেন। যেমন, আল্লাহ বলেন, "আল্লাহ যাকে হেদায়েত দিতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।" (সূরা আন'আম, ৬:১২৫) এই আয়াতে 'বক্ষ উন্মুক্ত করা' বলতে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের কথা বোঝানো হয়েছে, যা লতিফাসমূহের সক্রিয় হওয়ার সাথে সম্পর্কিত।
তাসাউফের এই জ্ঞান অত্যন্ত গভীর ও সূক্ষ্ম। এটি কেবল বই পড়ে বা মুখস্থ করে অর্জন করা যায় না, বরং একজন যোগ্য মুর্শিদ বা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সাধনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব। এই জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং আত্ম-শুদ্ধির পথে এলমে হুজুরি জ্ঞানে জ্ঞানান্বিত করিয়া একজন মানুষকে সঠিক সত্য ইসলামের পথ ও মতে নবী- রাসূলগণ সহ সাহাবা-কেরাম এবং অলি- আল্লাহগণের দেখানো প্রকৃত সুন্নিয়াতি তরিকায় সামিল করিয়া একজন মানুষ/জ্বীন-কে মুক্তিপ্রাপ্ত মুসলমান পরিচয়ে সঠিক ও সত্য ধর্মীও ধর্ম ইসলাম তথা শান্তি ও কল্যাণকর পথে পরিচালিত করে থাকে/করিতে পারে> ইনশাল্লাহ্-আমিন।