ইরান-ইসরায়েল সংঘাতঃ চীন-রাশিয়া ও উত্তরকোরিয়ার সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত মার্কিন আধিপত্যবাদ শেষ করে ক্ষমতার নতুন অক্ষাংশের যাত্রায় কি ইরান?
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান তীব্র সংঘাতের কারণে উত্তপ্ত। এই দুই আঞ্চলিক শক্তি দীর্ঘকাল ধরেই একে অপরের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন, যা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। এই সংঘাত কেবল ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং এর প্রভাব পড়ছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বজুড়ে, বাড়ছে আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা। মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একটি নতুন মেরুকরণ কি রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতায় ইরানের হতে যাচ্ছে – এমন প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সংঘাতের মূল কারণ ও বিবর্তনঃ- ইরান ও ইসরায়েলের শত্রুতার মূলে রয়েছে বেশ কিছু গভীর কারণ। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের শিয়া নেতৃত্ব ইসরায়েলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে আসছে এবং ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলের অভিযোগ এনেছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল ইরানকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার ইসরায়েলের উদ্বেগের প্রধান কারণ। ইরান লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে, যা ইসরায়েলের জন্য সরাসরি নিরাপত্তা হুমকি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরানের হস্তক্ষেপ এবং দামেস্কে ইরানি সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর ইসরায়েলের হামলা এই সংঘাতকে আরও উসকে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এই সংঘাত নতুন মাত্রা লাভ করেছে। গত ২ এপ্রিল ২০২৪-এ ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে একটি ইরানি কনস্যুলেট ভবনে হামলা চালায়, যাতে একাধিক জেষ্ঠ্য ইরানি কর্মকর্তা নিহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান ১৩ এপ্রিল ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এরপর ১৯ এপ্রিল ইসরাইল ইরানে পাল্টা প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়।
কৌশলগত যুদ্ধ পরিস্থিতির সাম্প্রতিক অবস্থাঃ- জুলাই-২০২৫ এর শুরুতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। ৭ জুলাই লোহিত সাগরে ইয়েমেনি গোষ্ঠীর হামলায় একটি জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা এই অঞ্চলের অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। ৬ জুলাই ইরানে বিস্ফোরণে বিপ্লবী গার্ডের দুই সদস্য নিহত হন। একই দিনে, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে আসেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি, যা ইরানে সংহতির বার্তা দিয়েছে। অন্যদিকে, মার্কিন হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ২ বছর পিছিয়ে গেছে বলে পেন্টাগন দাবি করেছে। ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা নিয়ে নতুন তথ্য দিয়েছে ইরান, যা পারমাণবিক বিতর্ককে আরও বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহলে এই সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। ৩ জুলাই ট্রাম্পকে পুতিন বলেছেন যে ইরানের সঙ্গে সংঘাত কেবল কূটনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিত। একই দিনে অসলোতে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বৈঠকে বসার কথা ছিল। তবে, ইরান লাখ লাখ আফগানকে গুপ্তচর সন্দেহে ফেরত পাঠাচ্ছে, যা আঞ্চলিক মানবিক সংকট তৈরি করছে।
চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক প্রভাবঃ- ইরান সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধে নিহতদের নতুন সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সরকারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ১,০৬০ জন নিহত হয়েছেন। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে তেহরান সতর্ক করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস’ জানিয়েছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে মোট ১,১৯০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪৩৬ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ৪৩৫ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। এছাড়া হামলাগুলোতে আরও ৪,৪৭৫ জন আহত হয়েছেন। গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যেও ইসরায়েলি হামলায় প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছে।
সামরিক শক্তির তুলনাঃ- সামরিক শক্তির দিক থেকে ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইরানের অবস্থান ১৪তম এবং ইসরায়েলের ১৭তম। সৈন্য সংখ্যার বিচারে ইরান এগিয়ে আছে, তাদের নিয়মিত সেনা প্রায় ১১ লাখ ৮০ হাজার, যেখানে ইসরায়েলের ৬ লাখ ৭০ হাজার। তবে, সামরিক বাজেটে ইসরায়েল (২৪৪০ কোটি ডলার) ইরানের (৯৯৫ কোটি ডলার) চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ব্যয় করে। যুদ্ধবিমান, অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্কের মতো কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েল এগিয়ে থাকলেও, আর্টিলারি, সাঁজোয়া যান এবং নৌ শক্তির (যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন) দিক থেকে ইরানের সক্ষমতা বেশি। ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে ধারণা করা হয়, যা ইরানের নেই বলে অনেকের ধারণা করে কিন্তু হঠাৎ ইরান তার সামরিক সক্ষমতা এতোটাই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত সামরাস্ত্রের বিপুল সম্ভারে তৈরি এবং মজুদ করে রেখেছে, যাহা সকল ক্ষেত্রে একযোগে আত্নঃপ্রকাশ করায় আজ পুরো বিশ্বকে এবং বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিধর দেশ গুলোকেউ মিরাক্কেলীয় ভাবে তাক লাগিয়ে দিয়েছে!
ভবিষ্যৎ গতিপথ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াঃ- রাশিয়া-চীন-উত্তর কোরিয়ার ভূমিকা বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি জটিল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে, যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে এবং কূটনৈতিক আলোচনার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে, ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই একে অপরের ওপর হামলা অব্যাহত রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এই সংঘাতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরানোর আহ্বান জানালেও, তাদের পূর্ববর্তী পদক্ষেপগুলো (যেমন JCPOA থেকে সরে আসা) ইরানের আস্থা নষ্ট করেছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়ার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একটি নতুন মেরুকরণ গঠনের ক্ষেত্রে এই দেশগুলো ইরানের প্রতি সমর্থন বাড়াতে পারে। রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে ইরানের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বজায় রাখতে সচেষ্ট। অন্যদিকে, চীন মধ্যপ্রাচ্যে তার অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে আগ্রহী এবং পশ্চিমা জোটের বিকল্প হিসেবে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে পারে। উত্তর কোরিয়াও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে ইরানের সম্ভাব্য সহযোগী হতে পারে।
যদি রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার সমর্থন ইরানের পক্ষে আরও জোরালো হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যবাদ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে এবং একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হতে পারে। এটি কেবল আঞ্চলিক সংঘাতকে আরও জটিল করবে না, বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যেও বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, উভয়পক্ষের অনমনীয় মনোভাব এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক মহলের সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য।