মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সমীকরণঃ যুদ্ধবিরতি নাকি ছদ্মবেশী কূটনীতি?
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট আবারও উত্তপ্ত। ইরান, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা এখন এক জটিল সমীকরণে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলোকেও অনেকে দেখছেন এক নতুন ধরনের কৌশল হিসেবে। এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বারবার হোঁচট খাচ্ছে, এবং এর পেছনে কাজ করছে গভীর অবিশ্বাস ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট্।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও অবিশ্বাসের দেয়ালঃ- দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে ইরান এবং তার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে গভীর অবিশ্বাস বিদ্যমান। বিশেষ করে, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা বা শান্তি আলোচনার আড়ালে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ উঠেছে বারবার। ফিলিস্তিন ও ইরানের সমর্থনপুষ্ট দেশগুলো অভিযোগ করে আসছে যে, ইসরায়েল ও আমেরিকা যখনই যুদ্ধবিরতির কথা বলেছে, তখনই মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা সরকার প্রধানদের গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারদের লক্ষ্য করে চালানো হামলাগুলো এই ধারণাকে আরও জোরালো করেছে যে, যুদ্ধবিরতি বা আলোচনার প্রস্তাব কেবল একটি “ছলনাময়ী ভাওতাবাজি” হতে পারে, যার উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে বের করা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্মূল করা। এই প্রেক্ষাপটে্, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনীর নিরাপত্তা এবং তার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, যা এই অঞ্চলের উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কৌশলঃ- যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বরাবরই নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে আসছে। তাদের মতে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার এবং পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে। ইসরায়েল, বিশেষ করে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ ও গাজার হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোকে ইরানের সমর্থনের বিষয়টিকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে তার মিত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে আসছে। তবে, তাদের যুদ্ধবিরতি বা কূটনৈতিক উদ্যোগগুলো প্রায়শই ইরানের পক্ষ থেকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, যেখানে এটিকে একটি “চালাকির লুকোচুরির চালবাঁজি” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ইরান ও তার মিত্রদের অবস্থানঃ- ইরান, চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো ইসরায়েল ও আমেরিকার এই কৌশলকে ভালোভাবে দেখছে না। তারা মনে করে, পশ্চিমা শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে এবং আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারসাম্যকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে এই ধরনের “ভাঁওতাবাজির নাটক” মঞ্চস্থ করছে। ইরানের সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে তাদের ইন্টেলিজেন্স শাখা, এই ধরনের গুপ্তহত্যা এবং কৌশলী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি বজায় রেখেছে।
বর্তমানে ইরানের সামনে দুটি পথ খোলাঃ- হয় ইসরায়েল-আমেরিকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে বিশ্বাস করে আলোচনা প্রক্রিয়ায় পা রাখা, অথবা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার পক্ষে থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি চালিয়ে যাওয়া। ইরান এবং তার মিত্ররা সম্ভবত এই মুহূর্তে দ্বিতীয় পথটিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, কারণ তারা মনে করছে, যেকোনো ধরনের দুর্বলতা প্রদর্শন তাদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির জটিল ও সহজিকরণের সমীকরণঃ- মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। একদিকে ইসরায়েল ও আমেরিকার নিরাপত্তা উদ্বেগ, অন্যদিকে ইরান ও তার মিত্রদের ঐতিহাসিক অবিশ্বাস এবং প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা। এই জটিল সমীকরণে যেকোনো ভুল পদক্ষেপ এই অঞ্চলকে এক ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলো যদি কেবল একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে, তবে তা কেবল অবিশ্বাসই বাড়াবে এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তির সম্ভাবনাকে আরও দূরে ঠেলে দেবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই পরিস্থিতিতে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করা, যাতে সত্যিকারের শান্তি আলোচনা সম্ভব হয় এবং মধ্যপ্রাচ্য একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।