কোরবানির প্রকৃত মর্মঃ আত্মত্যাগ বনাম আধুনিকতার আড়ম্বর!
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন এর লেখা ও সম্পাদনায়- ১ম পর্ব।
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা, যা কোরবানির ঈদ নামেই সমধিক পরিচিত। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তবে আমাদের নৈতিক বাস্তবতায় আধুনিক কোরবানির চিত্র অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রকৃত ধর্মীয় হকিকত থেকে বিচ্যুত। কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও গবেষক জাহারুল ইসলাম জীবন তার বিস্তৃত লেখনীতে কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট্, ধর্মীয় তাত্ত্বিকতা এবং বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন, যা কুরআন ও হাদিসের আলোকে কোরবানির প্রকৃত মর্ম উপলব্ধিতে সহায়ক। কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে্ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আত্মত্যাগঃ- কোরবানির মূল ভিত্তি হলো হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। প্রচলিত কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করার নির্দেশ দেন। দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর তিনি উপলব্ধি করেন যে, তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তার সন্তান ইসমাইল (আঃ)। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হন। ইসমাইল (আঃ) নিজেও আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে নিজেকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেন। যখন ইব্রাহিম (আঃ) চোখ বেঁধে ছুরি চালান, আল্লাহর অশেষ রহমতে ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে একটি বেহেশতি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়।
এই ঘটনা মূলত আল্লাহর প্রতি বান্দার পরিপূর্ণ আনুগত্য, প্রেম ও ভালোবাসার এক অবিস্মরণীয় পরীক্ষা। এখানে উদ্দেশ্য ছিল প্রিয় বস্তুর প্রতি জাগতিক মোহ ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া। আল্লাহপাক এই পরীক্ষায় ইব্রাহিম (আঃ)-কে উত্তীর্ণ করে কোরবানির এক চিরন্তন আদর্শ স্থাপন করেন, যা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুমিন মুসলমানদের উপর সামর্থ্য অনুযায়ী ফরজ করা হয়।
কোরবানির ধর্মীয় তাত্ত্বিকতা ও ষড়রিপু দমনঃ-
জাহারুল ইসলাম জীবনের বিশ্লেষণে, কোরবানির প্রকৃত হকিকত আরও গভীর। তিনি সৃষ্টি রহস্যের তাত্ত্বিকতা তুলে ধরে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা জ্বীন ও ইনসান (মানুষ) সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব রূপের অদৃশ্য নূরীও আত্মা দিয়ে, যাকে ‘জাতে হাকিকি’ বলা হয়। এই অদৃশ্য আত্মায় আল্লাহর আটটি সেফাতি গুণ (স্মৃতিশক্তি, ইচ্ছাশক্তি, দেখন শক্তি, কথন শক্তি, লেহন শক্তি, শ্রবণ শক্তি, অনুভূতি শক্তি, শ্বাস-প্রশ্বাস শক্তি) বিরাজমান থাকে। এছাড়াও, কাল্ব, রুহু, ছের, খফি, আকফা, আব্, আতশ, খাক্, বাদ, নাফস্ – এই দশটি গুণাবলী জ্বীন ও মানুষের মাঝে বিদ্যমান। এর মধ্যে আব-আতশ-খাক-বাদ (আগুন-মাটি-পানি-বাতাস) মানুষের জড় জগতের লতিফা, যা মৃত্যুর সাথে বিলীন হয়।
তবে, কোরবানির মূল শিক্ষা আসে ‘ছয় লতিফা’ বা ষড়রিপুর (কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা, হিংসা, নিন্দা, কামনা, বাসনা, লিপ্সা, অহংকার) দমনের মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এই রিপুসমূহ সহ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। জন্মকালে নিষ্পাপ থাকলেও, জাগতিক জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রভাবে এবং নফসের আম্মারা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মানুষ জাগতিক মোহে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। নিজের সন্তান, সম্পত্তি, অর্থ, পরিবার পরিজন—সবকিছুর প্রতিই এক ধরনের জাগতিক প্রেম সৃষ্টি হয়, যা আল্লাহর প্রতি নিবেদিত প্রেমকে আড়াল করে দেয়।
জাহারুল ইসলাম জীবন তার কাব্যিক ভাষায় এই গভীর সত্যটি তুলে ধরেছেনঃ-
**”মোনের পশুকে দাও কোরবানি ও-মোন
** বনের পশুকে-নই,
** এক-এক করে কোরবানি-দাও তুমি
** প্রতি বছর এক-একটি মনের-হিংস্রতার পশু হত্যার মাধ্য দিয়ে।
** কাম,ক্রোধ,লোভ-লালসা,হিংসা,নিন্দা, কামনার ষড় রিপুকে দাও কোরবানি,
** এক একটি পশুর উপর মনের অঙ্কনে নিজেকে ভর করে।”
** তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, কোরবানির অর্থ কেবল পশু জবাই করা নয়, বরং নিজের ভেতরের পশুত্ব বা ষড়রিপুকে কোরবানি দেওয়া। ছয়টি রিপুকে ছয় বছরে ছয়টি পশুর উপর ভর করে কোরবানি দিতে হয়। এর অর্থ হলো, যে বছর যে রিপুর কোরবানি করা হয়, সেই দিন থেকে কোরবানি দাতা সেই রিপুর কু-প্রভাব থেকে মুক্ত হবেন এবং কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত হবেন না।
সপ্তম কোরবানি হলো নিজের সত্ত্বাকে আল্লাহর রাহে কোরবানি করা। অর্থাৎ, নিজের নফসে আম্মারাকে হত্যা করে আল্লাহ তায়ালার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত করা। এই কোরবানি দেওয়ার পর মানুষ জীবিত থেকেও মৃত মানুষের ন্যায় হালাল ও প্রকৃত প্রয়োজন ব্যতীত সকল প্রকার কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলে।
আধুনিক কোরবানির বাস্তব চিত্র: আড়ম্বর ও লোক দেখানো প্রতিযোগিতা
দুঃখজনক হলেও সত্য, আধুনিক সমাজে কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রেই ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান ব্যক্তিগণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে, হারাম-হালালের পরোয়া না করে, কেবল লোক দেখানো সামাজিক স্ট্যাটাস এবং বড়লোকি ট্রেডিশনের উপর ভর করে কোরবানি দিয়ে থাকেন। প্রতিযোগিতামূলকভাবে বড় ও মোটা-তাজা পশু ক্রয় করা হয়, যেখানে মাংসের পরিমাণ এবং নিজেদের অহমিকা প্রদর্শনের হিসাব নিকাশই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।
এখানে কোরবানির প্রকৃত হকিকতের অভাব স্পষ্ট। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেম, ভালোবাসা বা নিজস্ব ঈমানী হৃদয়ের প্রিয় বস্তুকে কোরবানির দেওয়ার ফজিলতপূর্ণ ধর্মীয় আদেশ-নির্দেশ এবং প্রকৃত কোরবানির আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ মূল উদ্দেশ্য অনুপস্থিত থাকে।
জাহারুল ইসলাম জীবন এই বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন:
** “টাকার গরমে দিওনা কোরবানি লোক দেখানোর তরে,
** তোমার কোরবানি হইবে না দেখো হকিকতে।”
** তিনি মনে করিয়ে দেন যে, পাপ-পুণ্যের টাকা দিয়ে লোক দেখানো অহংকার বা দাম্ভিকতা ভরে কোরবানি দিলে আল্লাহর আদেশ অমান্য করা হয়। মনের পশু কোরবানি দেওয়া এতো সহজ নয়, এর জন্য জিন্দা থেকেই মৃত্যু সাধনা করতে হয়।
প্রকৃত কোরবানির নির্দেশনাঃ-
প্রকৃত কোরবানি হলো নিজের কষ্টার্জিত হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে সাধ্য ও সামর্থ্যের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা বা গোশতের হিসাব নিকাশ না করে, লোক দেখানো অহমিকা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে পশু ক্রয় করা। কোরবানির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পশুকে সন্তানের মতো যত্ন করে লালন পালন করতে হবে এবং এই পশুর উপর নিজের প্রিয় বস্তুকে (ষড়রিপু) স্থাপন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরবানি দিতে হবে।
মূলত, কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের আত্মার পরিশুদ্ধি ও জাগতিক মোহ থেকে মুক্তি অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছেন। এটি কেবল রক্তপাত নয়, বরং নিজের ভেতরের পাশবিক প্রবৃত্তিকে দমন করে আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য ও প্রেম প্রদর্শনের একটি মাধ্যম। আমাদের উচিত এই উৎসবের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে আত্মত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করা, যা কোরআন ও হাদিসের মূল শিক্ষা।