আজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস-২০২৫ঃ অধিকার আদায়ের দীর্ঘ পথে এখনো নানামুর্খী প্রতিবন্ধকতায় সমসাময়িক প্রেক্ষাপট্ !
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন।
আজ ১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের দীর্ঘ ও রক্তঝরা সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করছে। বাংলাদেশেও দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। তবে ২০২৫ সালের এই শ্রমিক দিবসটি এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে্ পালিত হচ্ছে, যেখানে একদিকে প্রযুক্তির অভাবিত উন্নয়ন কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ঐতিহাসিকভাবে মে মাসের এই দিনটি শ্রমিক শ্রেণির আত্মত্যাগের প্রতীক। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। সেই আন্দোলনের মূল সুর ছিল – ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শোভন জীবন। দীর্ঘ ১৩৯ বছর পরেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকরা আজও সেই অধিকারগুলোর জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের শ্রমিকদের পরিস্থিতিও ব্যতিক্রম নয়। তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও, এ শিল্পের শ্রমিকরা এখনও ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবের মতো বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। শ্রমিক সংগঠনগুলো সরকারের কাছে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
তবে পরিস্থিতির ইতিবাচক দিকও রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও অটোমেশনের প্রসারের ফলে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো শ্রমিকদের জন্য উপার্জনের সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। সরকারও দক্ষতা উন্নয়ন এবং কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দিচ্ছে, যাতে শ্রমিকরা পরিবর্তিত বাজারের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের শ্রমিকরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা হারাচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে কৃষি ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। জীবিকার সন্ধানে তারা শহরমুখী হচ্ছে, যা শহরের শ্রমবাজারে আরও চাপ সৃষ্টি করছে। এই জলবায়ু উদ্বাস্তু শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনৈতিক বৈষম্যও শ্রমিকদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। একদিকে কিছু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছেন, অন্যদিকে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। শ্রমিক সংগঠনগুলো ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছে।
এবারের আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন সভা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। এসব অনুষ্ঠানে শ্রমিক নেতারা তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরছেন এবং সরকারের কাছে শ্রমিকবান্ধব নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছেন।
পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ২০২৫ কেবল অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করার দিন নয়, বরং বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে একটি ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক কর্মপরিবেশ তৈরির অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। সরকার, শিল্পমালিক এবং শ্রমিক সংগঠন – সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই শ্রমিকদের উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।