ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য নীতিতে বড় ধাক্কাঃ দিল্লির ঘোষণায় ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বন্ধের পর সুতো আমদানিও বন্ধ করলো ঢাকা।
প্রধান বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (CBIC)-এর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য তাদের মাটি ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই, বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতো আমদানিও বন্ধ করে দিয়েছে। এই দুটি পদক্ষেপ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পিটিআইয়ের বরাত দিয়ে জানা যায়, CBIC তাদের বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতের স্থল, বিমানবন্দর এবং নৌপথ ব্যবহারের অনুমতি আর দেওয়া হবে না। এমনকি, ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে পণ্যবাহী কন্টেইনার ও ট্রাক কে অন্য দেশে যাতায়াতের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেপাল, ভুটান এবং মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের ২৯ জুন ভারত বাংলাদেশকে এই ট্রানজিট সুবিধা এবং ২০২০ সালে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা চুক্তি প্রদান করে ছিল।
ভারতের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে অনেকেই স্তম্ভিত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি এক প্রকার বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দিল্লি ঘোষণার মাধ্যমে ভারত তার সীমান্ত পথ বন্ধ করে দেওয়ায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এর পরপরই, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত থেকে সুতো আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতো আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হয়েছে। মূলত এই স্থলবন্দরগুলো দিয়েই ভারত থেকে সিংহভাগ সুতো আমদানি হয়ে থাকে।
এই পদক্ষেপকে অনেকে ভারতের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের সিদ্ধান্তের পাল্টা জবাব হিসেবে দেখছেন। এর আগে, বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ দেশীয় সুতোর ব্যবহার বাড়াতে স্থলবন্দর দিয়ে সুতো আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও এনবিআরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সুতোর গুণগত মান পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থলবন্দরগুলোতে এখনও প্রস্তুত নয়। তবে, সমুদ্রপথে বা অন্য কোনো উপায়ে সুতো আমদানি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
এই পরিস্থিতিতে ভারতও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান থেকে বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এনবিআর গত রোববার এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করেছে। ভারত থেকে যেসকল পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - ডুপ্লেক্স বোর্ড, নিউজপ্রিন্ট, ক্রাফট পেপার, সিগারেট পেপার, মাছ, সুতা, আলু, গুঁড়া দুধ, টোব্যাকো, রেডিও-টিভি পার্টস, সাইকেল ও মোটর পার্টস, ফরমিকা শিট, সিরামিকওয়্যার, স্যানিটারিওয়্যার, স্টেইনলেস স্টীলওয়্যার, মার্বেল স্ল্যাব ও টাইলস এবং মিক্সড ফেব্রিক্স। তবে, মূসক নিবন্ধিত বিড়ি উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল হিসেবে তামাক ডাঁটা আমদানি করতে পারবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে। চিনের সঙ্গে বিকল্প তিস্তাবাধ প্রকল্প সহ বাংলাদেশের অধিকাংশ ভারত সীমান্তীয় নদী প্রশাসন/শাসন করনের নানামুর্খী প্রকল্পে এমন সিদ্ধান্তে এবং কিছুদিন আগে চীনের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার কথিত মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতের প্রতিক্রিয়া বেশ তীব্র ছিল। অনেকেই মনে করছেন, ভারতের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের সিদ্ধান্ত সেই মন্তব্যের ফলশ্রুতি।
তবে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সুতো আমদানি বন্ধের কারণ হিসেবে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা এবং অবৈধ রি-এক্সপোর্ট বা রিরাউটিং প্রতিরোধের বিষয়টিকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে টেক্সটাইল, কাগজ ও সিরামিক খাতে দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই বাণিজ্য নীতি এবং ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধের ঘটনা উভয় দেশের অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যের উপর কেমন প্রভাব ফেলে, তা সময়ই বলবে। তবে, এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।