পাহাড়ে শুরু হয়েছে বর্ষবরণের নানামূর্খী আনন্দ অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্যের হাতছানি।
কেন্দ্রীয় বার্তা সম্পাদক- জাহারুল ইসলাম জীবন।পার্বত্য
জেলা রাঙামাটিতে শুরু হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বরণের ব্যাপক প্রস্তুতি ও বর্ণাঢ্য আয়োজন। প্রতি বছরের মতো এবারও চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই পাহাড়ের আনাচে-কানাচে শুরু হয়েছে বর্ষবরণের নানা অনুষ্ঠানমালা, যা চলবে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত। পাহাড়ি জনপদের প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি মহল্লা মুখরিত হয়ে উঠেছে বর্ষবরণের উৎসবের আমেজে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্ষবরণের এই উৎসব বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কাছে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত – বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, চাংক্রান, পাতা ইত্যাদি নামে এই সামাজিক উৎসবটি পালিত হয়। এটি পার্বত্য অঞ্চলের বৃহত্তম সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হওয়ায়, কেবল রাঙামাটিতেই এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রায় শতকোটি টাকার লেনদেনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি।
বাংলা নববর্ষের আগমনকে স্বাগত জানাতে ফাল্গুনের শেষ থেকেই পার্বত্য জেলাগুলোতে উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন কমিটি গঠন এবং নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়। চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকে উৎসবের মূল কার্যক্রম শুরু হয়, যা বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
এ বছরও রাঙামাটির চিত্র ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিজু মেলা। রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই মেলা চলবে আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। মেলায় ১৮০টি স্টলে পার্বত্য অঞ্চলের নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব তৈরি পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, ঐতিহ্যবাহী খাবার, খেলনা এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের বিভিন্ন সামগ্রী স্থান পেয়েছে। প্রতিদিন মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য থাকছে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি তুলে ধরতে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়াও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, বাহারি তরকারি দিয়ে পাঁজন রান্নার প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, রাঙামাটি শহরের মাঝের বস্তীস্থ শাহ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে চলছে দশ দিনব্যাপী জমজমাট বৈশাখী মেলা। প্রায় অর্ধশত স্টলের এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের বাহারি পণ্যের সমাহার দেখা যাচ্ছে। শিশুদের আনন্দ দিতে রয়েছে বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইড। এই মেলা চলবে আগামী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত।
বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষু-বিহু-সাংক্রাই-চাংক্রান-পাতা উদযাপন কমিটি রাঙামাটিও আগামী ৯ এপ্রিল থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তাদের আয়োজনে থাকছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নানা প্রকার গ্রামীণ খেলাধুলা।
বর্ষবরণের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে আগামী ১২ এপ্রিল ‘ফুল বিজু’র মাধ্যমে। এই দিনে কাপ্তাই হ্রদের জলে ফুল ভাসানো এবং ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানোর ঐতিহ্য পালন করা হয়। ১৩ এপ্রিল, চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হবে ‘মূলবিজু’। এই দিনে পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শত পদের তরকারি দিয়ে বিশেষ খাবার ‘পাঁজন’ রান্না করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন করা হয়। এরপর পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ‘গজ্জাপজ্জা’ নামে। এর পরেও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় কনসার্টসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন চলবে আরও প্রায় ১০-১৫ দিন।
এই দীর্ঘ উৎসবকে ঘিরে পার্বত্য জেলার পর্যটন ব্যবসা, খাবার, পরিবহন, ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে শুরু করে নতুন পোশাকের কেনাবেচা জমে উঠেছে। সারা বছর এখানকার ব্যবসায়ীরা এই উৎসবের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভালো ব্যবসার আশায়। রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, এই বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে রাঙামাটিতে প্রায় শতকোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হয়ে থাকে।
রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি অ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাঙামাটির মানুষ আরও ভালোভাবে উৎসব উদযাপন করছে বলে মনে হচ্ছে। পর্যটন স্পট থেকে শুরু করে শপিংমল ও মেলাগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান রাঙামাটির মানুষের সবচেয়ে বড় সামাজিক অনুষ্ঠান। এই উৎসব ঘিরে রাঙামাটিতে বিভিন্ন পণ্যের প্রচুর কেনাবেচা হয়। খাবার, পরিবহন, পর্যটনসহ অসংখ্য খাত এই উৎসবের সাথে জড়িত। যার কারণে প্রায় শতকোটি টাকা এই উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন ব্যবসা খাতে লেনদেন হয়ে থাকে।
মাঝেরবস্তী বৈশাখি মেলা ও সাংস্কৃতিক উৎসব উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক রাজন রক্ষিত বলেন, আমরা দশ দিনব্যাপী গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বৈশাখি মেলার আয়োজন করেছি যা চলবে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত এবং ১৫ এপ্রিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। মেলায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবারসহ নানা পণ্যের স্টল বসেছে।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার বলেন, আমাদের সংস্কৃতি যত উন্নত হবে তত আমরা এগিয়ে যাবো। এই বিজু মেলার মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে দেশসহ বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাই।
রাঙামাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) অনুপ কুমার চাকমা বলেন, এই উৎসব পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব। এই উৎসবের মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে আমরা সকলের সুখ, শান্তি ও মঙ্গল কামনা করি।
সব মিলিয়ে, পাহাড় জুড়ে এখন বর্ষবরণের এক আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমনও আশা করা যাচ্ছে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে আরও গতি সঞ্চার করবে।